একটি পেন্ডিং ফ্রেন্ড রিকোয়েষ্ট (ধারাবাহিক গল্পঃ পর্ব-৩)
লিখেছেন লিখেছেন মামুন ১৮ সেপ্টেম্বর, ২০১৪, ১০:৩৫:০৬ সকাল
৩.
নীলার ছোট্ট বাবুটা মোবাইল নিয়ে গেম খেলার জন্য কান্না শুরু করেছে।
অথচ ফেসবুকে গ্রুপ পোষ্টটা চেক করাও খুব জরুরী। পিসির নেট কানেকশন বাড়ির কর্তা ছেলেমেয়েদের পড়া-লেখার ক্ষতি হচ্ছে বলে মেয়াদ শেষ হবার পরে আর রিনিউ করেনি। আসল ঘটনাটা নীলা বেশ ভালোই বুঝতে পারছে।
ওর নিজের লেখাটার পরবর্তী পর্বটাও দেয়া হল না। মাহতাব রাগ করে থাকবে। ওর ভার্সিটি জীবনের এই বন্ধুটি একটু চাপা ধরণের। ওর রাগ-আনন্দ-উচ্ছাস বোঝা বড়ই দায়। যদিও মাহতাব গ্রুপ এডমিন। কিন্তু নীলার উপরে অনেক ভরসা করে থাকে।
শেষ পর্যন্ত মোবাইলটা দিতেই হল।
এটাই হচ্ছে আজকাল। কেমন একটা অবসাদ ওকে ঘিরে ধরে। একজন পরাজিত মানুষের অনুভুতি গ্রাস করে ফেলছে... ধীরে ধীরে।
মানুষ?
একজন পরাজিত মেয়ে মানুষ!
এই শব্দটা সবসময় ওর কাছে একটা ঘৃণা বয়ে আনে। শব্দটা কেমন একটা কামুকতার গন্ধ নিয়ে আসে যেন। এই পরিবারটা এখন আর ওর নিজের মনে হয় না। সে এখানে এখন কেবলি একজন মেয়েমানুষ।
চারটি ছেলেমেয়ের মা। এক মেয়ে এবং তিন ছেলে। কিন্তু ওরা কি মা মনে করে ওকে?
একজন মমতাময়ী মা?
না সারাদিন ঘর-গৃহস্থালি সামলে ওদের চাহিদা পূরণ করা এক শিক্ষিতা আধুনিক ক্রীতদাসী?
নাকি ওদের বাবার মত ওকেও একজন ‘ফাউল মেয়েমানুষ’ মনে করে?
এমন এক মেয়ে মানুষ যার সব শেষ কাজ ওদের বাবা নামের সব কিছু জোগাড় করে দেয়া কর্তা ব্যক্তিটির শরীরের সুখের উপকরণ হিসেবে নিজেকে এগিয়ে দেয়া।
ওদের বাবা সারাদিন পরে বাসায় এলে তার খাওয়া-দাওয়ার পরে বেডরুমের দরোজাটা কিছু সময়ের জন্য ভিতর থেকে বন্ধ থাকুক এটা এখন নীলার বড় মেয়ে এবং বড় ছেলেও যে চায়, সেটা ওদের হাবভাবে বুঝতে পারে। তাতে ওদের মা সুস্থ থাকুক আর নাই থাকুক। ওদের বাবা অপেক্ষা করলে মেয়ের চোখের তাকানো নীলাকে বলে দেয় ভিতরে যাবার জন্য। অথচ সে যে একজন মানুষ এই পরিবারের সদস্যরা এখন বেমালুম ভুলে গেছে।।
বড় মেয়ে এস এস সি পাশ করে কলেজে দ্বিতীয় বর্ষে। বড় ছেলে নিউ টেনে। আর বাকী দুই ছেলে প্রায় পিঠাপিঠি। সবচেয়ে বড় যে ব্যাপারটা ওকে পীড়া দেয় সেটা হল, যার হাত ধরে ভার্সিটিতে পড়াকালীন সময় প্রেমের জন্য ঘর এবং নিজের বাবা-মাকে ছেড়ে এসেছিল- আজ সেই মানুষটির হৃদয়ে ওর জন্য এক ফোঁটাও প্রেম নেই। ওর কাছে তো তাই মনে হয়।
একটা প্রচন্ড মন খারাপ করা অনুভুতিতে আচ্ছন্ন হয়ে বারান্দায় চলে এলো। বাইরের আকাশ আর নীল মহাশূন্য ওর মনের অসীম শুন্যতাকেই যেন তুলে ধরছে। বাসার সবার থেকে এই প্রকৃতিই যেন ওর অনেক আপন। মনের গুমোট ভাবটা একটু একটু করে কেটে যাচ্ছে। একসময় কলেজের শিক্ষকতাকে পেশা হিসেবে নিয়েছিল। সেই সুবাদে নিজেরও কিছু লেখা-লিখির হাত তৈরী হয়েছে। কিন্তু সময় এখন এতোটাই বিরুপ যে কোনো কিছুই লিখতে ইচ্ছে করে না। ইচ্ছের উৎসটা মরে গেছে।
ইকবাল এর কোন জিনিসটা নীলার খারাপ লাগতো? একটা সময় ছিল যে ইকবাল নামটা শুনেই পৃথিবীর সব ভাল লাগা ওর মনে এসে জড়ো হতো।
আর এখন?
আবার মনটা খারাপ হওয়া শুরু করেছে। আকাশের দিকে তাকিয়েও এখন আর মনকে খারাপ হওয়া থেকে ফিরাতে পারছে না। এই বারান্দাটা ওর নিজের। এই বাসাটা একটা এমন জেলখানা যার ভিতরে একচিলতে মুক্তাঙ্গন- এক চিলতে আকাশ হল এই বারান্দাটা!
মন খারাপের এক বিকেল বুকের ভিতরে নিয়ে নীলা ওর জন্য নির্ধারিত জেলখানায় ফিরে আসে। নীচে ইকবালের প্রাইভেট কারের হর্ণ শুনতে পাচ্ছে। আর কিছুক্ষণ পরেই একটা ভালবাসাহীন ভাললাগার লেনদেন করতে হবে।
শরীরটা শক্ত হয়ে আসে। একটা ধারালো ব্লেড দিয়ে নিজেকে কেটে ফালা ফালা করে ফেলতে ইচ্ছে হয়। কিন্তু পাশেই মোবাইল নিয়ে খেলারত একটি নিস্পাপ চেহারা ওকে এখনো শান্ত রেখেছে। একজন মেয়েমানুষের সাথে সাথে সে যে একজন মা ও!
একজন মমতাময়ী যার হৃদয়ে এই পরিবারের সকলের জন্য একসময় মায়ার সাগর বিরাজমান ছিল।
এখন সেটা শীতকালের এক মজা পুকুর!
... ...
সবাই ঘুমিয়ে পড়ার পর নীলা ওর একমাত্র আনন্দের উৎস বারান্দাটায় আসলো। সারা শরীর একটা ঘৃনায় রিরি করছে। জঘন্য একটা অনুভুতিতে ছেয়ে আছে মনটা। ইকবালের পাশবিক স্পর্শটা শরীর এবং মনে এখনো কষ্ট দিচ্ছে।
সুন্দর একটা গোল থালার মত চাঁদ উঠেছে।
হায় চাঁদ!
সময়গুলো যে কীভাবে চলে গেলো!
এইতো সেদিনের কথা মনে হচ্ছে... প্রথম পরিচয়... ইকবালের সাথে।
ওরা ছিল রিলেটিভ ।ওর কাজিন। মনে পড়ে বাগানে মাটি কাটার সময় একদিন নীলাকে মাটি কাটতে , বাগান করতে হেল্প করেছিলো ...
অনেক অনেক ভোর , সন্ধ্যার পর সন্ধ্যা পাশে পাশে হেঁটেছিল । কৃষ্ণচূড়ার ডাল নিয়ে দেবার জন্য লোকের সামনে মান সম্মান কেয়ার করেনি । সংসদ ভবনের সেই দিনগুলি নীলাকে কিছু প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলো ।
একদিন ভোরে হাঁটতে হাঁটতে ক্লান্ত হয়ে সংসদ ভবনের সামনের সিঁড়িটা দিয়ে উঠে আসার সময় হাত বাড়িয়ে দিয়েছিলো । নীলা এভাবে কারো হাত ধরে না । তবু স্বচ্ছ মনের মানুষ বলে তাকে বিশ্বাস করেছিল ।
একদিন সন্ধ্যায় যখন কারো বাঁশির সুর শুনে আনমনা হয়ে ওর পাশে নীলা হাঁটছিল , বিয়ের কথা উঠেছিলো । ওর অনিশ্চয়তার ভয় শুনে হেসে বলেছিল ,'তোমার মতো মানুষকে কেউ কষ্ট দিতে পারবে না ।' নীলা বিশ্বাস করেছিল সে ওকে চিনেছে , বুঝেছে।
ইকবালের তখন লেখার অভ্যাস ছিল। চিঠির জন্য অপেক্ষা করতো। কবিতার পর কবিতা লিখত নীলাকে নিয়ে। ওর রুমের দেয়ালে নীলার ছবি ছিল যার উপর সাইন পেন দিয়ে ওর কবিতা লেখা ছিল ।
ওর চিঠির ভিতর গাঢ় লাল গোলাপের পাপড়ি থাকতো । ও যখন গ্যারেজের ছাদে দাঁড়াতো, ইকবাল অকারণে গলির এপাশ থেকে ওপাশ হাঁটত আর গাইত ,' তুমি নির্জন উপকুলে নায়িকার মতো...
সে জানতো নীলা অন্য কাউকে ভালোবাসে । তবু একদিন ...
খুলনায় নীলাদের বাড়িটা হচ্ছিলো , দেখতে গিয়েছিলো । তখনো ওদের পুকুরটা হয়নি । একটা পুরনো ডোবা ছিল । তার পুরনো কাঠের তৈরি ঘাটে পা ভিজিয়ে অনেকক্ষণ , প্রায় এক ঘণ্টা গল্প করেছিলো । ইকবাল মুখ ধোয়ার জন্য এসেছিল ।
হঠাৎ ডান পায়ের বুড়া আঙ্গুলের নখে কিভাবে এক টুকরা নরম কাঠ ঢুকে গিয়েছিলো ।এমন অসহ্য যন্ত্রণা হচ্ছিলো ।একটা মুহূর্ত বছরের সমান।সে কি করে যেন কাঠের টুকরাটা ( টুথ পিকের মাথার সমান হবে) বের করে ফেললো। নীলা সত্যি কৃতজ্ঞ হয়েছিলাম ।
সেদিন যখন ওর পায়ের কাঠটা সরালো , তারপর সে নাস্তা করে কেন যেন বাইরে গেলনা। তখন নীলা ওর মাথার কাছে বসে ছিল।ওদের ঘরে বসে কি মনে হল মাথায় হাত রাখলো । ইকবাল চুপচাপ শুয়ে রইলো । এই পুরোটা দিন ওরা কেউ আর কোথাও যেতে পারলো না। নীলার কি হয়েছিলো আল্লাহই জানে।
রাতে সবাই ওর চাচার বাসায় নাটক দেখতে গেলো আর সে নীলাকে একেবারেই একা পেয়ে গেলো। তাও এতো কাছে । তখনো মাথার কাছে। নীলা ঠিক সচেতনভাবে কিছু ভাবছিলো না।
সে হঠাৎ সম্পর্কটা বদলে দিলো।
ওর মন খুব খারাপ হয়ে গেলো । একটা চুমুই । তবু অনেক ওলট পালট হয়ে গেলো। নীলার আগের সম্পর্কটা ভেঙ্গে গেলো। শিহাবের সাথে বিচ্ছেদের আগেই ইকবাল ওর জীবনে চলে আসলো ।
নীলার মনে কষ্ট জন্ম নিলো। কিন্তু সে দায়ী ছিলো বলে দোষ দিলো না। কিন্তু নিজের মনের বিরুদ্ধে হল বলে মেনেও নিতে পারলোনা। সে আবার শরীরের দিকে ঝুঁকলো । পুরো সম্পর্ক হলনা । তবু যা হল ওর জন্য অনেক বেশি হল। নীলার রাগ বাড়তে থাকলো। ওর মনের উপর আর কোন কন্ট্রোল থাকলো না।
শিহাবের সাথে অনেক সময় পরে এসব নিয়ে কথা হয়েছিলো । যখন এই সম্পর্কটা ফাইনালি ভেঙ্গে শিহাবের কাছে ফিরে যেতে তৈরি হয়েছিলো... ইকবাল একটা ছোট টেকনিক কাজে লাগাল... নীলার এক চাচার বিয়েতে শিহাব এসেছিলো । ইকবাল ওকে হোস্টেল থেকে সারপ্রাইজ দেবে বলে নিয়ে গেলো ।তখন দেখলো , শিহাবের পাশে আরেকজন । তাদের সম্পর্ক তখনো আসলে হয়নি । সম্ভাবনার মধ্যে ছিল।
তাদের হাসি ঠাট্টা দেখে রাগে আর কিছু বিবেচনা করলো না। বিয়ে করে ফেললো ইকবালকে । ওর এই বিয়ে অভিভাবকেরা মনে নিলেন না। বাধ্য হয়ে ইকবালের সাথে ঘর ছাড়তে হল। নীলা ওকে ওর অভিভাবক হিসাবে ভেবেছিলো। বিয়েতে ওর আগ্রহের অভাব টা সম্পর্ক নষ্ট করতে শুরু করলো। এরপর সংসারে আগ্রহের অভাব কষ্ট দিতে শুরু করলো... এভাবে সম্পর্কটা নষ্ট হয়ে গেলো... ধীরে ধীরে।
নীলার প্রতি বিতৃষ্ণা আর বিদ্বেষ পাল্লা দিয়েছিলো ওর প্রতি নীলার বিতৃষ্ণা আর বিদ্বেষের সাথে।
একটা গুরুতর কারণ ছিল সেক্স । অন্য কারণ ছিল ওর নির্দয়তা , যা ওর যুক্তি সঙ্গত মনে হতো , সে সেটাই করতো। তৃতীয় কারণ ওদের শিক্ষা আর কালচারের দূরত্ব ।
নীলার কিছু অযোগ্যতা আছে সে যা কাটানোর আপ্রাণ চেষ্টা করেছে সারাজীবন , এখনো করছে। ওর কিছু মানসিকতা নীলার পক্ষে মেনে নেয়া সম্ভব না। সে সংসার সম্পর্কে সবার চেয়ে ভিন্ন একটা স্বপ্ন দেখে আসছে। এই স্বপ্নটা ওকে সবার ইচ্ছার এই সংসারটার দিকে পুরো মন দিতে কখনো দেয় না।
চাঁদের আলোয় উদ্ভাসিত এক মধ্যবয়সের নারী তার বিগত জীবনের এক প্রেমিককে মনে করে কষ্ট পেতে থাকে... যাকে সে ভালবেসেছিল... কিন্তু সেটা তাকে বলার সুযোগ পায় নি... তার আগেই ঘটনাক্রমে অন্য একজনের কথার জালে... সাময়িক শরীরের চাহিদাটাকে ভালবাসা মনে করে আর একটা ভুল বোঝাবুঝির জন্য একজন ভুল মানুষের হাত ধরে ঘর ছেড়ে ছিল। যার জন্য আজ এই জেলখানায় বন্দী সে।
চাঁদের ভিতরে শিহাবের মুখখানিকে খুঁজে পেতে চেষ্টা করে...
শিহাবের হাসিই যেন গাছের পাতার আড়াল থেকে উঁকি মেরে ওর মুখে পড়তে থাকে।
হৃদয়ের রক্তক্ষরণকে অনুভব করে কষ্ট পাবার পাশাপাশি নীলা অন্য একধরণের আনন্দও পেতে থাকে।
মনে জেগে উঠে মুক্তির বাসনা।
(ক্রমশঃ)
বিষয়: সাহিত্য
৯৫১ বার পঠিত, ৯ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
শুভেচ্ছা রইলো।
এ ভাবে জীবনটাই নিঃশেষ হয়ে যায়....ধীরে ধীরে।
অনাকাংখিত বাস্তবতার সুনিপুণ চিত্রায়ণে আপনার জন্যে অনেক অনেক মায়াময় প্রকৃত ভালবাসা জানাচ্ছি......
শুভেচ্ছা আপনার জন্য নিরন্তর।
এ ভাবে জীবনটাই নিঃশেষ হয়ে যায়....ধীরে ধীরে।
অনাকাংখিত বাস্তবতার সুনিপুণ চিত্রায়ণে আপনার জন্যে অনেক অনেক মায়াময় প্রকৃত ভালবাসা জানাচ্ছি......
একদম আমার মনের কথাগুলোই বলেছেন কাহাফ ভাই। আমার আর কিছু বলার নাই।
আনন্দময় স্মৃতি মনে করে ও সুখ পাওয়া ।
শুভেচ্ছা আপনার জন্য নিরন্তর।
মন্তব্য করতে লগইন করুন